মনোজ রায় হিরু, আটোয়ারী (পঞ্চগড়) প্রতিনিধি ঃপঞ্চগড়ের আটোয়ারীতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯৩ তম জন্মবার্ষিকী বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে উদযাপিত হয়েছে।
আটোয়ারী উপজেলা প্রশাসন ও পরিষদের আয়োজনে ৮ আগষ্ট সকালে তাঁর প্রতিকৃতিত্বে পুষ্পমাল্য অর্পনের মধ্যদিয়ে কর্মসূচীর সূচনা হয়। অত:পর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মুসফিকুল আলম হালিমের সভাপতিত্বে পরিষদের কনফারেন্স রুমে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা শেষে বঙ্গমাতার ৯৩ তম জন্মদিনে ৯৩ জন শিক্ষার্থীকে আমলকি গাছের চারা এবং ১২ জন দুঃস্থ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলাকে সেলাই মেশিন উপহার দেওয়া হয়।
ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিনের কর্মসূচীতে অন্যান্যের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) শায়লা সাঈদ তন্বী, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রেনু একরাম, আটোয়ারী থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ সোহেল রানা, উপজেলা কৃষি অফিসার মোছা নুরজাহান খাতুন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ রাশিদা আক্তার রেশমা, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা করুনা কান্ত রায়, সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা মোঃ নজরুল ইসলাম সহ স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীগণ।
উল্লেখ যে, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম শেখ জহুরুল হক, মায়ের নাম হোসনে আরা বেগম। বাবা-মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান ফজিলাতুন্নেছার গায়ের রং ফুলের মতো ছিল বলে মা তাঁকে ডাকতেন রেণু নামে।
রেণুর বয়স যখন মাত্র তিন বছর তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। পিতামহ শেখ আবুল কাশেমের সিদ্ধান্তে তের বছর বয়সি চাচাত ভাই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তিন বছর বয়সে রেণুর বিয়ে দেওয়া হয়। রেণুর পাঁচ বছর বয়সে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়।
সাত বছর বয়সে রেণুর দাদার মৃত্যু হলে তাঁকে নিয়ে আসা হয় বঙ্গবন্ধুর মায়ের কাছে। বঙ্গবন্ধুর মাতা সায়েরা খাতুন নিজের সন্তানদের সঙ্গে রেণুকেও সন্তানস্নেহে লালন-পালন করেন।
বঙ্গমাতার শৈশব-কৈশোর কেটেছে টুঙ্গিপাড়ার প্রকৃতির কোলে; পাখি ডাকা, গাছগাছালি ঘেরা মধুমতী নদীর তীরে। শৈশব থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা, মানসিকতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা; প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গেই ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে ছিলেন।
বঙ্গমাতা তাঁর সামগ্রিক জীবনাচরণের মধ্যে ধারণ করে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, রাজনৈতিক জীবন এবং যাপিত জীবনকে। সে জন্যই তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিতে পেরেছিলেন একজন লড়াকু আদর্শ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে জীবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটানো বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্ধুদ্ধ হয়ে নিজের সব চাওয়া-পাওয়াকে বিসর্জন দিয়ে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে। বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নপুরুষ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যে মহীয়সী নারী সতত প্রেরণা যুগিয়েছেন, তিনিই বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব; বঙ্গবন্ধুর প্রিয় রেণু।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে শুধু বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন নীরব সংগঠক হিসেবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে শরিক হয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অনন্য ভূমিকার কথা আমরা বিশিষ্টজনদের স্মৃতিচারণা এবং লেখা থেকে জানতে পারি।
গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করে নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি পরামর্শ, সাহস আর অনুপ্রেরণা যুগিয়ে গেছেন আমৃত্যু। কোনো পদ-পদবির অধিকারী না হয়েও বঙ্গমাতা ছিলেন নারীর ক্ষমতায়নের এক অনন্য প্রতীক।
বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘জাতির পিতার জন্য প্রেরণা, শক্তি ও সাহসের উৎস ছিলেন বঙ্গমাতা।’ ৫৫ বছরের জীবনকালে বঙ্গবন্ধুকে বহুবার জেলে যেতে হয়েছে।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এক নাগাড়ে দুই বছরের বেশি সময় বঙ্গবন্ধু জেলের বাইরে থাকতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বঙ্গমাতা সংসার সামলে পাঁচটি সন্তানকে মানুষ করেছেন।
ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ, নানা রকম প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানো, আর্থিক সহযোগিতা করা, সমস্যাসংকুল সময়ে আওয়ামী লীগকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা, দলের আলোচনার সারাংশ কৌশলে জেলখানায় পৌঁছে দেওয়া; আবার বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে তুলে ধরা, বঙ্গবন্ধুর মামলার নথিপত্র সংরক্ষণ করা, মামলার খরচ যোগানোর জন্য প্রয়োজনে নিজের গয়না বিক্রি করা; এ সবই তিনি করেছেন নীরবে নিভৃতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও কর্মের ওপর আস্থা রেখে এ দেশের মানুষকে পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চারিত্রিক দৃঢ়তা, বিচক্ষণতা, মানবিকতা, মমত্ববোধ আর ভালোবাসা দিয়ে রচনা করেছিলেন ইতিহাসের এক মহাযজ্ঞ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস কম নয়। একাত্তরে হাজারও নারী হারিয়েছে নিজের ইজ্জত। পাকিস্তানি হায়নারা নারীদের সম্ভ্রম নিয়ে করেছে হোলিখেলা। এ বীরঙ্গনারা স্বাধীনতার পর যখন সমাজে উপেক্ষিত হয়ে অসহায়; তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন , ‘ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও- শেখ মুজিবুর রহমান। আর ঠিকানা লেখ ধানমণ্ডি বত্রিশ।
বাংলার নারীদের এভাবে সম্মান দিয়েছেন যে মানুষটি, তাকেই নির্মমভাবে স্বপরিবারে হত্যা করল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট অকৃতজ্ঞ কিছু বাঙালী। বঙ্গবন্ধুর আজন্ম ছায়াসঙ্গী, সহযোদ্ধা, সকল অনুপ্রেরণার উৎস বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা যে সম্মান আর ভালোবাসায় দুজন দুজনের প্রতি উৎসর্গীকৃত ছিলেন, ছিলেন পরস্পরের পরিপূরক, মৃত্যুকেও তাঁরা বরণ করে নিলেন একই সঙ্গে। তাঁদের সকলের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।