নিজস্ব প্রতিবেদন: অসুস্থ মারিয়া খাতুনের চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে বুধবার সকাল সোয়া ১০টায় ঢাকার মাতুয়াইলের বাসা থেকে বের হন মো. রাকিব। মাতুয়াইল থেকে বাসে উঠে যাত্রাবাড়ীতে এসে যানজটে পড়েন। এরপর ওয়ারীর রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনে আসার পর বাস আর চলছিল না।
কোনো যানবাহন না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করেন। গাড়িতে এবং হেঁটে হাসপাতালে পৌঁছাতে সময় লেগেছে সোয়া তিন ঘণ্টা। দুপুর দেড়টায় পৌঁছান তারা, ততক্ষণে বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। চিকিৎসা করাতে না পেরে ফিরে যান তারা।
হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে রাকিবের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সাধারণত বাসা থেকে ঢামেক হাসপাতালে পৌঁছাতে সময় লাগে ৩০-৩৫ মিনিট। আজ (গতকাল) রোদে পুড়ে কষ্ট করে হেঁটে এসেও বোনের চিকিৎসা করাতে পারলাম না।’
কোটা সংস্কারের দাবিতে গতকাল সকাল ১০টার পর ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালনে রাস্তায় নামেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। যানজটে আটকা পড়ে মারিয়ার মতো অনেক অসুস্থ রোগী দুর্ভোগের শিকার হন। সকাল ১০টার পর রাজধানীর শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, মৎস্য ভবন, গুলিস্তান, চানখাঁরপুলসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে ঢাকার ভেতরের প্রায় সব সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রিকশা পর্যন্ত চলতে বাধা দেওয়া হয়। শুধু রোগী বহনকারী গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স চলাচল করতে দেন তারা। তাও রোগী ও চিকিৎসাপত্র দেখার পর এসব গাড়ি ছাড়া হয়। আন্দোলনকারীদের বাধার মুখে পড়ে অনেকেই অনুরোধ করেন তাদের গাড়িটি যেতে দেওয়ার জন্য। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনুরোধ রাখেননি আন্দোলনকারীরা। বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেন মানুষ। তপ্ত রোদের মধ্যে হাঁটতে গিয়ে অনেকেই অসুস্থবোধ করেন। গাড়ি না পেয়ে অসুস্থ এবং প্রবীণদেরও হেঁটে যেতে হয়েছে গন্তব্যে। আটকে পড়া গাড়ি নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাস্তায় বসে থাকতে হয়েছে চালককে।
ভোগান্তির শিকার বেশির ভাগ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, রাস্তা অবরোধ করে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলা হচ্ছে। জরুরি কাজ কিংবা প্রয়োজনীয় কাজে মানুষকে রাস্তায় বের হতে হয়। রাস্তা বন্ধ না করে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে বৈঠক করতে পারেন বলে মন্তব্য করেন অনেকেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাড়ি নিয়ে বের হয়েই শাহবাগে আন্দোলনকারীদের বাধার মুখে পড়েন। এ নিয়ে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কোটা আন্দোলনকারীদের আমার পরিচয় দিলাম। বললাম আমি ডাক্তার। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের অধ্যাপক। আমার আইডি কার্ড দেখালাম। বললাম, আমার অসুস্থ শাশুড়িকে দেবরের বাসায় দেখতে যাচ্ছি। তারা জিজ্ঞেস করল আমি কোটার পক্ষে নাকি বিপক্ষে। বললাম, মুক্তিযোদ্ধদের সম্মান দেখাতে হবে সবার। তারা রেগে গেল।’
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল শাহবাগ ও এর আশপাশ এলাকা। অথচ এই এলাকাতেই রয়েছে দেশের তিনটি বৃহৎ হাসপাতাল– ঢাকা মেডিকেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বারডেম হাসপাতাল। প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন এসব হাসপাতালে। সড়ক বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে রোগী ও তাদের স্বজনদের।
আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতাল থেকে গতকাল একজন রোগীকে ঢামেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ওই রোগী ও রোগীর স্বজনদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালক আনোয়ার হোসেন সাড়ে ১২টার দিকে রওনা হন। ঢামেক হাসপাতালে পৌঁছান দুপুর ২টার কিছু আগে। হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে আনোয়ার সমকালকে বলেন, মোড়ে মোড়ে আন্দোলনকারীরা গাড়িতে রোগী দেখার পর ছেড়েছে।
ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে কুমিল্লার নাঙ্গলকোর্ট থেকে রোগী নিয়ে আসা অ্যাম্বুলেন্স চালক আলাউদ্দিন ও রোগীর স্বজন রবিউল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। রবিউল জানান, তাদের বাড়ি নাঙ্গলকোর্টের বেতাগাঁও গ্রামে। তাঁর বাবা হানিফ ভূঁইয়া (৭০) কিডনিসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। বাড়ি থেকে সকাল ৯টায় রওনা দিয়ে দুপুর ২টায় ঢামেকে পৌঁছেছেন। যানজটে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল তাদের জীবন।
অ্যাম্বুলেন্স চালক আলাউদ্দিন বলেন, নাঙ্গলকোর্ট থেকে আসতে সর্বোচ্চ সময় লাগার কথা আড়াই ঘণ্টা, সেখানে পাঁচ ঘণ্টায় পৌঁছালাম। শনিরআখড়া থেকে যানজটে পড়েন তারা।
বিকেল ৩টায় মৎস্যভবন মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তার চারপাশ বন্ধ রেখে বিক্ষোভ করছেন। রিকশায় মাইক লাগিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন কোটার বিরুদ্ধে। হাইকোর্টের পাশের সড়কে আটকে থাকা যানবাহনের চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বেলা ১১টা থেকে তারা সেখানে আটকা পড়েছেন। কেউ তিন ঘণ্টা, কেউ চার ঘণ্টা বসে আছেন। সব যাত্রীই গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেন। আন্দোলনকারীদের নির্ধারিত সময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে চালকদের সেখানেই থাকতে হবে।
মৎস্য ভবন মোড়ে বিকেল ৩টায় প্রাইভেটকারের চালক বাদল মিয়া জানান, বনানী থেকে একজন ব্যাংকারকে নিয়ে মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে বের হয়েছিলেন। এখানে ১১টায় আটকা পড়েছেন। কর্মকর্তা নেমে হেঁটে বনানী চলে গেছেন। তিনি গাড়ি নিয়ে বসে আছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, কোটা আজীবনের ভোগান্তি। কিন্তু এই আন্দোলন সাময়িক ভোগান্তি। এই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের নয়। এটা কৃষকের আন্দোলন, শ্রমিকদের আন্দোলন। সরকার দাবি মেনে নিলে আমরা পড়ার টেবিলে ফিরে যাব। তিনি বলেন, অ্যাম্বুলেন্স ও রোগী বহনকারী গাড়িকে বাধা দেওয়া হয়নি বরং দ্রুত যেতে সহায়তা করা হয়েছে।