রতন বালো, মানিকগঞ্জ : স্বপন কুমার বালো। বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। স্টুডিও ও ফটোগ্রাফী তার পৈতৃক পেশা। মানিকগঞ্জ মূল শহরের বাসিন্দা। নানা আবেদন নিবেদনের পর বাসায় তিতাস গ্যাস সংযোগ প্রাপ্ত হন। রান্না করতে গৃহীনিদের কিছুটা হলেও সুখ হয়। কিন্তু এই সুখ কয়েক দিনের মধ্যে চলে যায়। গৃহীনিদের রান্নার কষ্ট আবার আকড়ে ধরে। এ কষ্ট প্রায় এক যুগ ধরে চলে আসছে। অথচ বিল দিতে হচ্ছে ঠিকই। এটা যেন তাদের মড়ার উপর ‘খাঁড়ার ঘা’। এখন তাদের এলপি গ্যাসে রান্নার কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু দফায় দফায় এলপি গ্যাসের মূল্যও বাড়ায় বাসায় জ¦ালানি কাজের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। কখনো আবার জ¦ালানী কাঠও ব্যবহার করা হয় প্রয়োজন মেটানোর জন্য।
আশরাফ আলী। তার বয়সও ৬০ এর কাছাকাছি। চা বিক্রি করাই তার মূল পেশা। মানিকগঞ্জের শহীদ রফিক সড়কে তার দোকান। ৪০ বছর যাবৎ এ পেশা পরিচালনা করছেন। চায়ের দোকান চলে কেরোসিনের স্টবে। কিন্তু তিন দফায় জ¦ালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তার ব্যবসার খরচ বেড়ে যায়। পরে এলপি গ্যাসের একটি সিলিন্ডার বসান। সেটার মূল্যও বাড়তে থাকে। পরে লোকজন ধরে তিতাস গ্যাসের সংযোগ প্রাপ্ত হন। কিন্তু সেটাও দীর্ঘদিন স্থায়ী হলো না। গ্যাস কমতে শুরু করায় তার চায়ের ব্যবসায় ধ্বস নামতে শুরু হয়েছে।
পৌর এলাকার গ্রাহক মো. আলহাদ হোসেন বলেন, প্রায় এক যুগ কোন গ্যাস নেই কিন্তু বিল নেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে সিলিন্ডার গ্যাসের দামও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি। সরকার নির্ধারিত ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ৪৯৮ টাকা স্থলে নেয়া হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। আমাদের ওপর এই জুলুম দেখার কেউ নেই।
গৃহিনী রেবেকা সুলতানা বলেন, প্রায় দশ বছর আগে মাঝে মাঝে গভীর রাতে গ্যাস আসতো। আমরা রাত জেগে হলেও তা দিয়ে রান্নার কাজ করতাম। কিন্তু এখন গ্যাস নাই অথচ কোম্পানি নিয়মিত বিল নিচ্ছে। এটা কি নাগরিকদের সঙ্গে অন্যায় নয়?
শুধু স্বপন বালো, আশরাফ আলী, মো.আলহাদ হোসেন, রেবেকা সুলতানা নয় তার মত ১২ হাজার আবাসিক গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা বলেছেন, গ্যাস ও আর্থিক সংকটের পাশাপাশি কাঁচামালের স্বল্পতাসহ নানা সমস্যায় কারখানাগুলোয় উৎপাদন কমে যাচ্ছে। মানিকগঞ্জে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার (বিসিক) বন্ধ হয়ে যাওয়া পথে। প্লট বরাদ্দ পেয়ে ব্যাংকঋণ নিয়ে কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের লাপাত্তা হওয়া, গ্যাস-সংকট, জনবলের অভাব, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নানা সমস্যায় মানিকগঞ্জের বিসিক শিল্পনগরীর রুগ্ন দশা। ফলে ৩৫ বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না এই বিসিক শিল্পনগরী। বর্তমানে ২৪টি শিল্পকারখানার মধ্যে ১৩টি কারখানা চালু রয়েছে।
এভাবে বছরের পর বছর গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ না করে কোটি কোটি টাকা অন্যায় ও বেআইনীভাবে বিল আদায় করার অভিযোগে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে তিতাস গ্যাস কোম্পানির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রীট মামলা করা হয়েছে। মানিকগঞ্জ গ্রাহকদের পক্ষ থেকে গত ১৪ জানুয়ারি রিট মামলা আবেদনটি করেছেন মানিকগঞ্জের বেউথা এলাকার বাসিন্দা মা. আরশেদ আলী। মামলার প্রেক্ষিতে গত ৩০ জানুয়ারি বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবির এর আদালতে শুনানী শেষে তিতাস গ্যাস কোম্পানীর বিরুদ্ধে রুল জারি করেন কেন অন্যায় ভাবে ও বেআইনী বিল স্থগিত ঘোষনা করা হবে না। ৪ সপ্তাহের মধ্যে জবাব দেয়ার জন্য তিতাস গ্যাস কোম্পানীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নিয়মিত বা অনিয়মিত কোনভাবেই গ্যাস সরবরাহ না করে গত একযুগে মানিকগঞ্জ সদর ও শিবালয় উপজেলা অঞ্চলের জনগণের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিল হাতিয়ে নিয়েছে তিতাস গ্যাস কোম্পানি। নিয়মিত গ্যাসের দাবিতে আলোচনা, মিছিল-মিটিং, আন্দোলন করেও কোন লাভ হয়নি আবাসিক গ্রহকদের বরং জনগণের গ্যাসের দাবির মিছিলে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন অনেক গ্রাহক। পুলিশ বাদী মামলায় জেল-জুলুম এবং হয়রানির শিকার হয়েছেন জেলার গ্রাহকরা। তিতাসের চাপে দিশেহারা সাধারণ গ্রাহক এখন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাতেও হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
২০১০ সাল থেকে জেলায় গ্যাস সরবরাহ কমতে থাকে। ২০১২ সালের প্রথম দিকে আবাসিক গ্রাহকরা সপ্তাহে শুধু শুক্রবার গ্যাস পেত। কিন্তু একই বছরের ছয়মাস না যেতেই গ্যাস সরবরাহ শূন্যের কোটায় চলে আসে। গ্যাস না পেয়েও বছরের পর বছর নিয়মিত বিল দিতে থাকা গ্রাহকরা অসহায় হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জেলা আ’লীগের সহ-সভাপতি, তৎকালীন ও বর্তমান মানিকগঞ্জ পৌর মেয়র মো. রমজান আলীর নেতৃত্বে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবিতে পৌরবাসীর মিছিলে পুলিশের টিয়ার শেল ও গুলিতে আহত হয় দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিক, সাধারণ জনণসহ মেয়র, তার স্ত্রী ও ভাই মো. দেলোয়ার হোসেন আহত হন। পুলিশ বাদী মামলায় সাধারণ নিরপরাধ মানুষ জেল-জুলুম ও হয়রানির শিকার হয়েছিলেন বলেও রয়েছে ব্যাপক অভিযোগ।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির মানিকগঞ্জ অঞ্চলের ম্যানেজার প্রকৌশলী মো. আতিকুর হক সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হল তিনি বলেন, আমাদের দৈনিক চাহিদা ২২.৬ কিউবিক ফিট (এমএমসিএফডি) গ্যাস কিন্তু আমরা গ্যাস পাচ্ছি ১১.৮ এমএমসিএফডি। প্রতিদিন ঘাটতি থাকছে ১১ এমএমসিএফডি। আবাসিকে প্রতি এমএমসিএফডি গ্যাসের দাম ১৮ টাকা এবং সিএনজি পাম্পে ৩৫ টাকা। এই এলাকায় আবাসিক ডাবল চুলা হচ্ছে ২১ হাজার ৭৭৩টি এবং একক চুলা হচ্ছে ১ হাজার ১০৯টি। ডাবল চুলার প্রতি মাসে বিল ১ হাজার ৮০ টাকা এবং একক (সিঙ্গেল) চুলার বিল হচ্ছে ৯৯০ টাকা।
এছাড়া ১৭টি সিএনজি পাম্প ও ৪৩টি শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ আছে। তার হিসাবেই শুধু আবাসিকে প্রতি মাসে বিল করা হয় ২ কোটি ৩৫ লাখ ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা এবং বছরে ২৯ কোটি ৫৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। এ হিসাবে গত ১২ বছরের মধ্যে যে সামান্য গ্যাস ছিল তাতে পুরো ২ বছরও যদি নিয়মিত সরবরাহ ধরা হয় তাহলে বিগত ১০বছর কোন গ্যাস ছিল না। এ হিসাবে গত ১০ বছরে ২৯৫ কোটি ৩৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা শুধু আবসিক গ্রাহকদের কাছ থেকে বিল নিয়েছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ গ্যাস না দিয়েই। ম্যানেজার আরও জানান, আশুলিয়ার সিএমবি রোড ডিআরএস ( প্রেসার নিয়ন্ত্রক) হতে সাভার-মানিকগঞ্জ হয়ে আরিচাঘাট পর্যন্ত এই লাইন আছে।
তিনি বলেন, সংযোগ থাকলে অবশ্যই বিল দিতে হবে। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই। তবে যারা লাইন বিচ্ছিন্ন করতে আসছে আমরা তাদের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি। এ পর্যন্ত ৬০টি লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে এবং আরও অবেদন আছে বিচ্ছিন্ন করার। তাছাড়া গ্যাস না দিয়েই বিল নেয়ার বিষয়ে তিতাস কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট হয়েছে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সব সময় অবহিত করছি। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হতে কতদিন লাগবে তা বলতে পারবো না।
শিবালয় উপজেলার সাবেক ব্যাংকার মো. মহিউদ্দিনের বলেন, আমার বাসায় মোট ৮টি লাইন ছিল। আগেই ৭টি কাটা হয়েছে। আজ সর্বশেষটি বিচ্ছিন্ন করার আবেদন করে গেলাম। গ্যাস পাবো না কিন্তু বছরের পর বছর বিল আর কতকাল দিবো।
জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান রুমেল বলেন, সিলিন্ডার গ্যাসের দাম যারা বেশি নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। তাছাড়া শুনেছি ওমেরা, বেক্সিমেকো, বসুন্ধরা অবৈধভাবে বেশি দাম নিচ্ছে, তাদের প্রতিনিধিদের হেড অফিসে ডাকা হয়েছে।
পৌর মেয়র ও জেলা আ’লীগের সাবেক সহ-সভাপতি মো. রমজান আলী বলেন, গ্যাস পাওয়ার দাবিতে আন্দোলন করায় আমার পরিবারের ওপর গুলি করা হয়েছিল। আমার ভাই, স্ত্রী এবং আমিও আহত হয়েছিলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে গ্যাস না পেলে বিল দেবো না এবং সবাইকে বলে দেই গ্যাস না পেলে তোমরাও বিল দিবে না। তাতে হাইকোর্ট আর সুপ্রিম কোর্ট যাই করা হোক। আমার পৌরবাসী আর কতকাল গ্যাস না পেয়েই বিল দিব? এমন করে আক্ষেপ করেন তিনি।
সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবসায়ী বুলবুল এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. বুলবুল বলেন, প্রতি ১২ কেজি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম কোম্পানি থেকেই বেশি নেয়া হচ্ছে। সিলিন্ডার বিক্রি করে সামন্য লাভ হলেই আমাদের চলে কিন্তু কোম্পানিরাই তো সরকার নির্ধারিত দামে আমাদের দিচ্ছে না। সরকার নির্ধারিত দাম ১ হাজার ৪৯৮ টাকা হলেও বসুন্ধরা, টোটাল, বেক্সিমকো বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ টাকা এবং ফ্রেস, যমুনা, ইউনি, ডেল্টা, পেট্রোমেক্স বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬৫০ টাকায়।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. আবদুল লতিফ বলেন, গ্যাসের সংকটের বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অবগত করা হয়েছে। যদি গ্যাস সরবরাহ না হয় তাহলে যেন বিল না নেয়া হয় তারও প্রস্তাব দিয়েছি। আর সিলিন্ডার গ্যাসের বেশি দাম নেয়ার বিষয়টি নিয়ে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিবো।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুলতানুল আজম খান আপেল বলেন, আমি গ্যাস না পেয়ে আমার বাসার লাইন গত ৪ মাস আগেই বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। আমার দাবি যাদের বিগত সময়ে গ্যাস সরবরাহ করা হয়নি তাদের বিল মওকুফ করা হোক।
গ্যাস সংকটের কারণে বাসা বাড়ীসহ মানিকগঞ্জের বিভিন্ন শিল্প কারখানায় উৎপাদনে ধস নেমেছে। জেলার একাধিক শিল্প কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানিকগঞ্জে দীর্ঘ গ্যাসের সংকট চলছে ১৫ বছর ধরে এ সংকট আরও প্রকট হয়েছে। সিএনজি ষ্টেশন গুলো ২৪ ঘন্টায় ১/২ঘন্টা গ্যাস পাইলেও আবাসিক গ্রাহকদের চুলা জলেনা ১৫ বৎসর ধরে। অথচ শুধু আবাসিক গ্রাহকদেও থেকেই প্রতি মাসে প্রায় ৯ কোটি টাকা গ্যাস বিল নিচ্ছে তিতাস গ্যাস কোম্পানি ।
সাটুরিয়া উপজেলার নয়াডিঙ্গী এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে রাইজিং ¯িপনিং মিল। জেলার অন্যতম বৃহৎ এই কারখানায় সুতা ও কাপড় তৈরি হয়। উপমহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন) মো. কলিম উদ্দিন বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না থাকায় কারখানা মালিককে প্রতি মাসে গড়ে ৫০ লাখ টাকা অতিরিক্ত অর্থ খরচ হচ্ছে। গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন সচল রাখতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। উৎপাদন বিভাগের হিসাব মতে, মে মাসে ১ কোটি ৭৮ লাখ ৬২ হাজার টাকা গ্যাসের বিল পরিশোধের পরও বাড়তি ৪৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল গুনতে হয়েছে। জুলাই মাসে গ্যাসের বিল ১ কোটি ৬১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা দেয়ার পর ৫৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয়েছে।